তখন আমার বয়স সাত কি আট। আমাদের বাড়িতে সেসময়ে মাটির ভিটির ঘর, সম্ভবত টিনের বেড়া। গ্রামের অধিকাংশ ঘরই তখন এমন। টিন যারা কিনতে পারতো না, তারা ছন দিয়ে ঘর বানাতো।
তো, একদিন চোর ধরা পড়লো। সবাই বলাবলি করতে লাগলো অমুকের বাড়িতে শিংওয়ালা চোর (সিঁধেলচোর) ধরা পড়েছে। তাকে বাজারে নিয়ে পেটানো হচ্ছে, আচ্ছামত গণধোলাই যাকে বলে আরকি! বেজায় কৌতুহল জাগলো! গরু, ছাগলের এবং ভেঁড়ার শিং দেখেছি, তখন আমাদের ওদিকে মহিষ একদমই ছিলনা। তাই এর বাইরে তেমন ‘শিংওয়ালা প্রাণী’ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। এখন যেহেতু বাজারে শিংওয়ালা চোর আছে, এই সুযোগ হাতছাড়া করা যাবেনা। আমি আর আমার দুই বছরের বড় চাচাতো ভাই মিলে মহাউৎসাহে বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একটু ভয়ও পাচ্ছিলাম পাছে যদি গুতো দেয়!
বাজারে গিয়ে আগ্রহের আর সীমা থাকলো না। বাজারের ঠিক মাঝে খুব সম্ভবত অর্জুন গাছ ছিল। সেই গাছের চারপাশে শ’কতক মানুষ গোলাকার হয়ে ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝে কে যেন মানুষের মতো শব্দ করে গোঙাচ্ছে। আমরা বহুকষ্টে ভীড় ঠেলে ভেতরে যা দেখলাম তাতে হতাশই হতে হলো! এ কি! এতো মানুষের মতো দেখতে একজনকে বেঁধে রেখেছে! আর তার শিং কোথায়! নাকি শিং ভেঙে ফেললো? এসব ভাবতে ভাবতে বাড়ি ফিরে জানলাম চোরদের শিং থাকেনা। চোরেরাও মানুষ। তারা অভাবের তাড়নায় চুরি করে।
চোরদের নিয়ে সমাজে স্টিগমার অন্ত নাই। কিন্তু আবার যে অত্যন্ত বড়মাপের চোর, সমাজে তার ‘সম্মান’, ‘প্রতিপত্তির’ সীমা নাই। এই স্টিগমা যদি ধর্ষকদের প্রতি থাকতো, যদি এদেরকে সমাজে বয়কট করা হতো, একঘরে করে রাখা হতো, তাহলে সম্ভবত ধর্ষকামীতা কিছুটা হ্রাস পেত।
কিন্তু ধর্ষণতো অধিকাংশ ক্ষেত্রে যৌনাকাঙ্ক্ষা থেকে করা হয়না, ধর্ষণ করা হয় ক্ষমতা প্রদর্শনের লক্ষ্যে। ক্ষমতার বলয়ে থেকে তাই এই ধর্ষকরা সমাজে টিকে যায়, অদৃশ্য শক্তি এদের টিকিয়ে রাখে।
গণধোলাই বা ক্রসফায়ার আসলে অপরাধ নির্মূলের মাধ্যম না। সমাজে এই অপরাধ প্রবণতা কমাতে গেলে আগাছাকে বাড়তে দেওয়া যাবেনা, আগেই নিংড়ে ফেলতে হবে। এজন্যে আগাছা নিধন অভিযান চালাতে হবে। রেইপিস্ট এবং পটেনশিয়াল রেইপিস্টরা আপনার, আমার চেয়ে অনেক দূর্বল। এদেরকে প্রতিহত করা কঠিন কাজ না। নির্মূল অভিযান আপনি শুরু করুন, দেখবেন শত শত মানুষ আপনাকে অনুসরণ করবে।
কিন্তু যে আগাছা ইতোমধ্যে বড় হয়ে গিয়েছে? আসুন দাবি তুলি ধর্ষণের বিচার ত্রিশ দিনের মধ্যে শেষ করতে হবে। যৌন সহিংসতা ঘটলে সেটাকে সংবেদনশীল হয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে পুলিশের বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্ষণ বা যৌন সহিংসতা সংক্রান্ত অপরাধকে জামিন অযোগ্য অপরাধ হিসেবে সাব্যস্ত করতে হবে।