১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে মানসিক অসুস্থতাকে অসুখ হিসাবেই দেখা হয়না। মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত চিকিৎসার সুযোগ যেমন একদিকে অত্যন্ত সীমিত, অপরদিকে চিকিৎসা নিতে চাওয়া/যাওয়া-কে সামাজিকভাবে ‘ট্যাবু’ হিসেবে দেখা হয়, রোগী ‘স্টিগমাটাইজড’ হয়ে যায়। মানসিক সমস্যাকে তাই চেপে যাওয়ার প্রবণতাই বেশি দেখা যায়। মানসিক রোগকে অন্য ৮-১০টা রোগের মতোই মূল্যায়ন করতে হবে। কাউন্সেলিং বা থেরাপি বা মেডিকেশন প্রয়োজন হলে অন্যান্য রোগের ডাক্তারের মতো মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা কাউন্সেলরের কাছে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে কোনো রোগই জিইয়ে রাখা যাবেনা। সঠিক সময়ে মানসিক অসুস্থতার সমাধান না করার ফলেই আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটে।
যে কয়েকটি মানসিক অসুস্থতা সাধারণত দেখা যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো – ১. হতাশা (Chronic Depression), ২. উদ্বেগ/দুশ্চিন্তা (Anxiety Disorder), ৩. আতঙ্ক (Panic Disorder), ৪. অত্যধিক-অমোঘ ব্যাধি (Obsessive Compulsive Disorder-OCD), এবং ৫. দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্য (Post-Traumatic Stress Disorder)।
১. হতাশা (Chronic Depression) হলে নিজেকে অবসাদগ্রস্থ বলে মনে হয়, সকল কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যায়, সবসময় একরকম ক্লান্তি ভর করে নিজের উপর। দেখা গেল আপনি হয়তো বিছানায় শুয়ে আছেন কিন্তু ঘুম হচ্ছেনা। ফলে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে দিন কাটে এবং স্মৃতিশক্তি লোপ পায়। আমি যাদের কাউন্সেলিং করিয়েছি, তাদের মধ্যে অনেকেই এই সমস্যা নিয়ে এসেছে। দেখা যায় এক সেমিস্টারে হয়তো জিপিএ ছিল ৩.৫, পরের সেমিস্টারে হতাশায় ভুগে একধাক্কায় জিপিএ নেমে আসে ৩.২ এর ঘরে।
২. উদ্বেগ/দুশ্চিন্তা (Anxiety Disorder) হলে মূলত ব্যক্তি তার চিন্তায় আর লাগাম টানতে পারেনা। Over-thinking এর ফলে অনেকে সামান্য ঘটনাকে অনেক বড় করে দেখে, নিজের চিন্তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এর ফলে উচ্চরক্তচাপ, অনিদ্রা, অবসাদ ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়। এর ফলে মনোযোগ দেওয়ার ক্ষমতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
৩. আতঙ্ক (Panic Disorder) এর একটি উদাহরণ দিয়ে শুরু করি। আমাদের এক ব্যাচের এক মেয়ে শিক্ষার্থী বরাবরই ফাইনাল পরীক্ষার হলে মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এর মূল কারণ panic disorder। এই ছাত্রী যেমন পরীক্ষাকে অত্যধিক ভয় পায়, এরকম অনেকেই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ভীত থাকে এবং সেসব বিষয়কে মোকাবেলা করতে যেয়ে বা মোকাবেলা করতে হবে এই চিন্তা এলেই তাদের panic disorder শুরু হয়। হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, মেয়েদের ক্ষেত্রে হঠাৎ ঋতুস্রাব শুরু হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয় আতঙ্কগ্রস্ত হলে। দীর্ঘমেয়াদের ফলাফল হিসেবে বিভিন্ন ফোবিয়া বা ভীতি তৈরি হয় নিজের মধ্যে। এজন্যে Panic Disorder-কে হালকাভাবে না দেখে থেরাপি বা কাউন্সেলিং নিয়ে এর সমাধান বের করা অত্যন্ত জরুরি।
৪. অত্যধিক-অমোঘ ব্যাধি (Obsessive Compulsive Disorder-OCD) হলে সাধারণত রোগী একটি বিষয় নিয়েই সারাদিন ভাবতে থাকে। রুম গোছানো নিয়ে অনেকের মধ্যে একরকম অবসেশন দেখা যায়, অনেকের মধ্যে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়। আমি বলছি না পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা যাবেনা বা সবকিছু গুছিয়ে রাখা দোষের, কিন্তু OCD-তে ভোগা মানুষ অগোছালো বা অপরিষ্কার কিছু দেখলে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
৫. দুর্ঘটনা পরবর্তী মানসিক বৈকল্য (Post-Traumatic Stress Disorder-PTSD) সবচেয়ে সাধারণ একটি মানসিক রোগ। যেমনঃ ছোটবেলায় ঘটে যাওয়া মানসিক, শারিরীক বা যৌন নির্যাতন ভিক্টিমের মধ্যে স্থায়ী প্রভাব তৈরি করতে পারে। এর ফলে পরবর্তীতে বড় হয়েও সেই দুর্বিষহ স্মৃতি বয়ে নিয়ে বেড়াতে হয় এবং বিভিন্ন সময়ে সেসকল স্মৃতি মনে পড়ে। এসব স্মৃতি পরবর্তীতে দুঃস্বপ্ন হিসেবে দেখা দিতে পারে।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনো শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকলে পরবর্তীতে তার যৌন জীবনে এবং অন্যকে বিশ্বাস করা বা না করা নিয়ে তার মধ্যে মারাত্মক দ্বিধা কাজ করতে পারে। যৌন সহিংসতা, শারিরীক বা মানসিক নির্যাতনের শিকার হওয়া ইত্যাদি কারণে PTSD দেখা দিতে পারে। এই রোগের লক্ষণ দেখা দিলে রোগীর মধ্যে খিচুনি দেখা দিতে পারে বা সে হঠাৎ ঘেমে উঠতে পারে।
পরিতাপের বিষয় হলো অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নেই। অথচ প্রায় প্রতি মাসেই একাধিক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পাওয়া যায়। সঠিক সময়ে কাউন্সেলিং করা গেলে এদের কেউ-ই হয়তো আত্মহত্যার পথ বেছে নিতো না।
আসুন মানসিক স্বাস্থ দিবসে দাবি জানাই যেন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং দেশের সকল উপজেলায় মনোরোগ বিশেষজ্ঞ নিয়োগ দেওয়া হয়। পাশাপাশি, আসুন আমরা মানসিক অসুস্থতাকে অন্য আট দশটি রোগের মতো স্বাভাবিকভাবে দেখি।